প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও বিরোধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের আলোচনার পর সরকারের সংস্থাপন উপদেষ্টা এইচটি ইমামের সাক্ষাতের পর পুরো দৃশ্য পাল্টে গেল। প্রধান বিচারপতি সকাল ১১টায় সুপ্রিমকোর্টে যাওয়ার কথা খালেদা জিয়ার আইনজীবীদের জানালেও এইচটি ইমামের সঙ্গে সাক্ষাতের পর আর সেখানে যাননি। সকাল ১০টা ৪৪ মিনিটের দিকে এইচটি ইমাম পতাকাবাহী গাড়িতে করে প্রধান বিচারপতির বাস ভবন ত্যাগ করেন। ওই সময় সেখানে ১০ জনের মতো গোয়েন্দা সংস্থা ও পুলিশের কর্মকর্তা ও সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। তার প্রস্থানের পরই আইন পুলিশের সংশ্লিষ্টরা চলে যান। তিনি সুপ্রিমকোর্টের কার্যালয়ে আসবেন এই প্রতীক্ষায় বেগম খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা হাইকোর্টের রায় স্থগিতের জন্য আবেদন প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। অপেক্ষায় ছিলেন প্রধান বিচারপতির। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও সাবেক বিচারপতি টিএইচ খান আদালতে এসে পৌঁছেন। বেগম জিয়ার অন্য আইজীবীরা টিএইচ খানের সঙ্গে দেখা করে কৌশল নির্ধারণ করে সিদ্ধান্ত নেন প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে স্থগিতের আবেদন উপস্থাপন করবেন। শেষ পর্যন্ত প্রধান বিচারপতি না আসায় স্থগিতের আবেদন নিয়ে আদালতে যাওয়া হয়নি।
এদিকে দুপুরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে খালেদা জিয়ার কৌঁসুলি ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেছেন, বেগম জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের কাজটি প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের পুরোপুরি বিপরীত। বেগম জিয়াকে উচ্ছেদ করা হবে না প্রধান বিচারপতির এমন আশ্বাসের পর উচ্ছেদ প্রক্রিয়া তারই প্রমাণ।
গতকাল শনিবার দুপুরে সুপ্রিম কোর্ট বার এসোসিয়েশনের দক্ষিণ হলে সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি এ কথা বলেন।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ বলেন, প্রধান বিচারপতি আমাদের আশ্বস্ত করে বলেছিলেন, বিচারাধীন বিষয় হওয়ায় আপিল নিত্তি না হওয়া পর্যন্ত সরকার খালেদা জিয়াকে বিরক্ত (ডিস্টার্ব) করবে না। কিন্তু আমরা এখন শুনতে পাচ্ছি বেগম জিয়ার থাকার কক্ষের দরজা ভাঙা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতির এই বক্তব্যের পর উল্টো কাজ করা হচ্ছে। প্রধান বিচারপতির সম্মান রক্ষার জন্য, শালীনতার জন্য বলিনি যে, তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন। কিন্তু এখন বলতে বাধ্য হয়েছি। মনে হচ্ছে প্রধান বিচারপতির কোন সম্মান-মর্যাদা নেই।
আমরা যেন কোনো সভ্য দেশে বসবাস করছি না। দেশে কোনো সভ্য সরকার নেই। সভ্য সরকার থাকলে এ ধরনের আচরণ করতো না। বিচার ও আইন তো নেই-ই।
সাংবাদিক সম্মেলনে সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন বলেন, আমরা প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বলেছি, আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী মামলা বিচারাধীন থাকলে সরকারের সে বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ নেই। প্রধান বিচারপতি আমাদের আশ্বস্ত করে বলেন, আমি বিশ্বাস করি মামলা বিচারাধীন থাকায় বেগম জিয়াকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদের বিষয়ে কিছু করা হবে না। তার কথা বিশ্বাস করে আমরা চলে এসেছি। এরপর সেনা নিবাসের বাড়ির গেট ভেঙ্গে আইন-শৃক্মখলা বাহিনী ভিতরে ঢুকে ভাংচুর করেছে। তাহলে দেশের কোথায় আইনের শাসন রয়েছে? কোথায় রয়েছে গণতন্ত্র? কোথায় রইল সুপ্রিমকোর্টের ভাবমূর্তি? শহীদ জিয়াউর রহমানের স্মৃতি বিজড়িত বাড়ি থেকে বেগম জিয়াকে উচ্ছেদ করে সরকার শান্তিতে দেশ চালানোর কথা ভেবে থাকলে ভুল করবেন।
আমরা আশঙ্কা করছি, তাকে জুলুম করে জোরপূর্বক বের করে দিয়ে বলা হবে তিনি স্বেচ্ছায় চলে গেছেন। এই কাজ করা হলে দেশে অশান্ত পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আমরা খবর পেয়েছি, বিভিন্ন জায়গায় প্রতিবাদ শুরু হয়েছে, বিক্ষোভ চলছে।
ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার বলেন, বেগম জিয়ার বাড়িতে জোর করে ঢুকে আইন-শৃক্মখলা বাহিনী'র সদস্যরা বাড়ির কর্মচারীদের গ্রেপ্তার করেছে। এটি যদি হয়ে থাকে তাহলে প্রধান বিচারপতির বক্তব্য মিথ্যা হয়ে যায়। তার আশ্বাস উপেক্ষিত হলে আইনের শাসন ব্যাহত হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টের মর্যাদা ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। সুপ্রিমকোর্টের মর্যাদা রক্ষায় এই উচ্ছেদ বন্ধ রাখা উচিত। প্রেস ব্রিফিংয়ের এক পর্যায়ে টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে বেগম খালেদা জিয়া বর্তমান পরিস্থিতি তুলে ধরে সাংবাদিকদের জানাবেন। কিন্তু বেগম জিয়ার মোবাইলে কথা বলার পর জানা যায় তাঁর থাকার কক্ষের দরজা ভাঙ্গা হচ্ছে। এই মূহূর্তে তনি কোন কথা বলার অবস্থায় নেই। ফলে টেলিকনফারেন্স সম্ভব হয়নি। প্রেস ব্রিফিং শেষে বেগম জিয়ার আইনজীবীরা বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের বিষয়বস্তু ও একটি উকিল সনদ নিয়ে সেনা নিবাসের উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন সাবেক এটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী, সিনিয়র আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী ও এডভোকেট জয়নুল আবেদীন, এডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, এডভোকেট হেলাল উদ্দিন মোল্লা, এডভোকেট এবিএম ওয়ালিউর রহমান খান, এডভোকেট ফেরদৌস আক্তার ওয়াহিদা, এডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, এডভোকেট জাকির হোসেন ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার এ কে এম এহসানুর রহমান, ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী, এডভোকেট মির্জা আল মাহমুদসহ শতাধিক আইনজীবী।
প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাৎ :
বিএনপি চেয়ারপার্সনকে সেনানিবাসের বাড়ি থেকে উচ্ছেদের খবর শুনে গতকাল শনিবার সকালে তাঁর কৌঁসুলিরা প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের সঙ্গে রাজধানীর হেয়ার রোডস্থ তাঁর বাসভবনে দেখা করেন। সকাল সোয়া নয়টার দিকে সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিক-উল হক, সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ ও সুপ্রিমকোর্ট বার এসাসিয়েশনের সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতির বাসায় যান। নয়টা ৪০ মিনিটের দিকে খন্দকার মাহবুব হোসেন প্রধান বিচারপতির বাড়ির গেটে থাকা সুপ্রিমকোর্ট বারের সেক্রেটারি ব্যারিস্টার এম বদরুদ্দোজাকে ভেতরে নেয়ার জন্য আসেন। এ সময় তিনি জানান, খালেদা জিয়ার সঙ্গে তাঁর কথা হয়েছে। খালেদা জিয়া বলেছেন, তিনি আইনজীবীদের সঙ্গে পরামর্শ না করে বাড়ি ছাড়বেন না। সাক্ষাতের পর তাঁরা সোয়া ১০টার দিকে বের হয়ে আসেন।
পরে সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতির কক্ষে অনুষ্ঠিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে ব্যারিস্টার রফিক-উল হক বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে কথা বলে আমাদের বিশ্বাস জন্মেছে যে ২৯ নবেম্বরের আগে বেগম জিয়াকে বিরক্ত (ডিসটার্ব) করা হবে না। স্বেচ্ছায় বাড়ি ছাড়ার বিষয়ে পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ সম্পর্কে তিনি বলেন, এ খবর মিথ্যা-ভিত্তিহীন। কয়েকটি গণমাধ্যমে প্রচারিত এ ধরণের খবর প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, তা না হলে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তার দায়ভার সংবাদ মাধ্যমকেই নিতে হবে।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি সবের্বাচ্চ আদালতে বিচারাধীন। এ অবস্থায় কোনো পদক্ষেপ নেয়া অনুচিত হবে। পদক্ষেপ নিলে তা সুপ্রিম কোর্টের প্রতি অবমাননা হবে।
আইনজীবীদের বিক্ষোভ :
আইনজীবীরা প্রধান বিচারপতির বাসা থেকে সুপ্রিমকোর্টে ফিরে আসার পর সুপ্রিমকোর্টে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। সুপ্রিমকোর্ট বার ভবনে দফায় দফায় বিক্ষোভ মিছিল করেন আইনজীবীরা। কিছুক্ষণ পর আইনজীবীদের একটি মিছিল সুপ্রিমকোর্ট প্রাঙ্গন প্রদক্ষিণ করে প্রধান ফটকে গিয়ে অবস্থান নেয়। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের কেন্দ্রীয় সভাপতি ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়ার নেতৃত্বে আইনজীবীদের একটি দল মিছিল করে প্রেসক্লাবের সামনে যান এবং সেখানে সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন। বিক্ষোভ মিছিলে আরো অংশ নেন সিনিয়র আইনজীবী নিতাই রায় চৌধুরী, এডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার, এডভোকেট হেলাল উদ্দিন মোল্লা, এডভোকেট এবিএম ওয়ালিউর রহমান খান, এডভোকেট ফেরদৌস আক্তার ওয়াহিদা, এডভোকেট গাজী কামরুল ইসলাম সজল, এডভোকেট জাকির হোসেন ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার রাগীব রউফ চৌধুরী, এডভোকেট মির্জা আল মাহমুদ, এডভোকেট মোহাম্মদ আলী প্রমুখসহ শতাধিক আইনজীবী। ফোরামের সুপ্রিমকোর্ট ইউনিটের সভাপতি জয়নুল আবেদীনের নেতৃত্বে আইনজীবীরা প্রেসক্লাবে না গিয়ে সুপ্রিমকোর্টের প্রধান ফটক থেকে আবার সুপ্রিমকোর্টে ফিরে যান। আইনজীবীরা স্লোগানে বলেন, ‘‘খালেদা জিয়া ভয় নাই রাজপথ ছাড়ি নাই’’ ‘‘লড়াই লড়াই লড়াই চাই,লড়াই করে বাঁচতে চাই’’ ‘‘এই লড়াইয়ে জিতবে কারা শহীদ জিয়ার সৈনিক যারা’’আইনজীবী জনতা গড়ে তোলো একতা,‘‘খুনি হাসিনা হুঁশিয়ার এই মুহূর্তে বাংলা ছাড়’’।