সংবিধানের প্রথম সংশোধনী এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের কয়েরকটি ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ রিটের শুনানি শুরু হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা ও বিচারপতি কাজী রেজা-উল হক সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ এ মামলার আংশিক শুনানি শেষে আগামী রোববার সকালে পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেছেন।
রিট আবেদনের শুনানিতে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, যুদ্ধাপরাধের বিচারের জন্য আইন প্রণয়নের আগে ১৯৭৩ সালে বিল উত্থাপন করা হলে সংসদে বির্তক হয়। সংসদের আলোচনায় বলা হয়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিহ্নিত ১৯৫ জন সদস্যের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে বিচার করা হবে। ওই সময় সরকার যুদ্ধাপরাধের বিচার উদ্দেশ্যে কমিশন গঠন করে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা সদস্যকে হত্যা, ধর্ষণ, অগ্নি সংযোগ ও মানবতা বিরোধী অপরাধের মতো চারটি কর্মকান্ডে জড়িত থাকায় চিহ্নিত করে। তাদের বিচারের জন্যই ওই বছরের ১৫ জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধনী আনা হয়। সংশোধনীর পাঁচদিন পর প্রণীত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন। এর একটাই উদ্দেশ্য ছিল ১৯৫ জন চিহ্নিত পাকিস্তানী সেনা সদস্যের বিচার করা। যেহেতু তারা বাংলাদেশের নয় পাকিস্তানের নাগরিক এ জন্য মৌলিক অধিকার বঞ্চিত করা হয়। কিন্তু চিহ্নিত ওই ১৯৫ পাকিস্তানী সেনা সদস্যের বিচার বাদ দিয়ে ২০০৯ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে কিছু সংশোধন করে যে কোন ব্যক্তির বিচার এবং শাস্তির বিধান জুড়ে দেয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বাদ দিয়ে এ দেশের নাগরিকের বিচারের ক্ষেত্রেও মৌলিক অধিকার বঞ্চিত করান বিধান বাতিল করা হয়নি। যা সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী।
শুনানি শেষে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক সাংবাদিকদের বলেন, আদালত জানতে চেয়েছেন ৭৩ সালের আইনটি একটি বিশেষ আইন তাহলে সংবিধান সংশোধনী ও আইনটি কেন চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে জবাবে বলেছি সংবিধানের তিনটি মোলিক কাঠামো রয়েছে। এর একটিতেও হাত দেয়া হলে তা চ্যালেঞ্জ করা যাবে। ১৯৭৩ সালের আর্ন্তজাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনটি সংবিধানের মৌলিক অধিকার পরিপন্থী। এ কারণেই আইনটি চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। তিনি বলেন, যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা সদস্যকে বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংবিধানের প্রথম সংশোধন আনা হয়। ২০ জুলাই ওই সংশোধনীর আলোকে আইন করা হয়। তখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য যে তালিকা করা হয় সেই তালিকায় কোন বাংলাদেশী নাগরিক ছিল না। ১৯৫ জন পাকিস্তানী সেনা সদস্যের বিচারের জন্য এ আইন করা হয়।
আদালত আমাকে প্রশ্ন করেছিল ১৯৭৩ সালের সংবিধানের প্রথম সংশোধনী এবং ১৯৭৩ সালের ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস ট্রাইব্যুনাল অ্যাক্ট এখন কেন চ্যালেঞ্জ করলেন। উত্তরে বলেছি এই আইনের আওতায় পিটিশনারদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, এজন্য তা চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। আদালত বলেন, আপনারা আপিল বিভাগে যান। এর জবাবে বলেছি চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত এর আগের অন্তর্বর্তী কোন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। আদালত এ বিষয়ে এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছেন।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক শুনানিতে বলেন, সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ মতামতের ভিত্তিতেও কোন আইন পাস হলে যদি তা সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিপন্থী হয় তাহলে হাইকোর্টের জুডিশিয়াল রিভিউ করার ক্ষমতা রয়েছে। কারণ সংসদ আইন করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার খর্ব করতে পারে না। আবার সংবিধানের মৌলিক কাঠামোর পরিপন্থী যে কোন আইন জুডিশিয়াল রিভিউ করতে পারেন হাইকোর্ট। তিনি এ বিষয়ে সংবিধানের ৮ম সংশোধনী মামলার রায় আদালতে উপস্থাপন করে বলেন, জুডিশিয়াল রিভিউ হল সংবিধান ও গণতন্ত্রের মৌলিক কাঠামো। আদালত এ পর্যায়ে বলেন সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদের যে বিধান রয়েছে তা দেশের সকল নগরিকদের জন্য নয়,কেবল যারা সামরিক বাহিনী ও সহায়রক বাহিনীর সদস্য হয়ে সুনির্দিষ্ট চারটি অপরাধ করেছে তাদের জন্য প্রযোজ্য। জবাবে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন যারা সেনা বাহিনী বা আর্মড ফোর্সের অধীনে থাকে তাদেরকে সহায়ক বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য বলা হয়। অর্থাৎ যারা সেনাবাহিনীর অধীনে থেকে যুদ্ধ করে বা যুদ্ধের কাজে সহায়তা করে তারাই সহায়ক বাহিনী। আর যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত পিটিশনাররা কোনভাবেই সহায়ক বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত হননি। কারা সহায়ক বাহিনী তা চার্জ গঠনের পর বলা যেতে পারে। কিন্তু ট্রাইব্যুনাল এক্ষেত্রে আইন লঙ্ঘন করে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়াই চার্জ গঠনের আগে গ্রেফতারী পরোয়ানা জারি করেছে। এখানে উল্লেখ্য যে সংবিধানের ৪৭(৩) অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতা বিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সশস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারীতে সোপর্দ কিংবা দন্ডদান করার বিধান সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসামঞ্জস্য বা তাহার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য করা হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না।
শুনানিতে আদালত জানতে চান ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হলে আপিল বিভাগে যাওয়ার বিধান রয়েছে সেখানে না গিয়ে হাইকোর্টে এসেছেন কেন? জবাবে ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, ট্রাইব্যুনালের চূড়ান্ত রায়ের আগে আপিল বিভাগে যাওয়ার সুযোগ রাখা হয়নি। অন্তবর্তী আদেশে সংক্ষুব্ধ হলে কী ধরনের প্রতিকার পাওয়া যাবে তা আইনে নেই। প্রশ্ন হলো জুডিশিয়াল রিভিউ ও মৌলিক অধিকার খর্ব হলে সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি প্রতিকারের জন্য তাহলে কোথায় যাবেন? এসময় আদালত ৭৩ সালের ট্রাইব্যুনাল আইনের ২১ ও ২৪ ধারা পড়ে এটর্নি জেনারেলের কাছে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা জানতে চান।
ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেন, রিট আবেদনকারীদের যুদ্ধাপরাধের মামলার অভিযোগে নয় অন্য আইনে গ্রেফতারের পর দুটি মামলায় আটক রাখা হয়েছে। ৭৩ সালের আইনটি পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর চিহ্নিত ১৯৫ জন সদস্যের জন্য প্রণয়ন করা হলেও রিট আবেদনকারীদের ওই আইনে আটক রাখায় তারা সংক্ষুব্ধ হয়ে রিট আবেদনটি চ্যালেঞ্জ করেছেন।
প্রসঙ্গত গত সোমবার জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মোহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আবদুল কাদের মোল্লা সংবিধানের প্রথম সংশোধনীর মাধ্যমে ৪৭(৩) ও ৪৭ (এ)(১) ও (২) অনুচ্ছেদ এবং '৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইনের ৩(১), ৬(২), ৬(৮), ১৯(১), ১৯(৩), ২৩ ও ২৪ ধারার বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন দায়ের করেন।
শুনানির সময় রিট আবেদনের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের সভাপতি এডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেন, বারের সম্পাদক ব্যারিস্টার মো. বদরুদ্দোজা বাদল, এডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী, সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট নজরুল ইসলাম ও এডভোকেট জয়নুল আবেদীন, ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন এমপি, ব্যারিস্টার ফখরুল ইসলাম, এডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার, এডভোকেট ফরিদ উদ্দিন খান, এডভোকেট তাজুল ইসলাম, ব্যারিস্টার বেলায়েত হোসেন, ব্যারিস্টার মাসুদ আহমেদ সাঈদ, ব্যারিস্টার এহসান এ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার ইমরান এ সিদ্দিক, ব্যারিস্টার মীর আহমাদ বিন কাসেম প্রমুখ। সরকার পক্ষে ছিলেন এটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত এটর্নি জেনারেল এমকে রহমান।